আমাদের প্রাত্যহিক জীবন বেচাকেনা, লেনদেনের সঙ্গে জড়িত। ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি বড় অংশ বেচাকেনা পদ্ধতিতে সম্পন্ন হয়। এ ছাড়া আধুনিককালে ইসলামী ব্যাংকিং বিনিয়োগ নীতিমালায় বেচাকেনা একটি আবশ্যকীয় মূলনীতি। ব্যাংকের বাই-মুরাবাহা, বাই-মুয়াজ্জাল, বাই-সালাম, বাই-ইসতিসনা ও বাই-আস-সরফের ক্ষেত্রে মালপত্র/পণ্য বা মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয় হয়ে থাকে। তাই ক্রয়-বিক্রয়ের বেলায় ইসলামী শরিয়াহর মূলনীতি অবশ্যই জানা থাকতে হবে।
ক্রয়-বিক্রয় : ক্রয়-বিক্রয় আরবি শব্দ ‘বায়উন’ থেকে এসেছে। একজনের মাল অপরজনের মালের সঙ্গে পারস্পরিক স্বেচ্ছাসম্মতির ভিত্তিতে বিনিময় করাকে ‘ক্রয়-বিক্রয়’ বলে। অন্যভাবে বলতে গেলে, কোনো জিনিস নগদ অর্থের সঙ্গে বিনিময় করাকে ‘বিক্রয়’ বা বাই বলে। ক্রয়-বিক্রয় সহিহ হওয়ার চার শর্ত। যথা—১. আকদ বা চুক্তি, ২. মুবি বা বিক্রীত জিনিস, ৩. ‘ছামান’ বা মূল্য এবং কবজা বা দখল।
বাই-বাতিল : কোনো বস্তু বা পণ্য বিক্রয় বাতিল হয়ে যাবে, যদি না তা বিক্রয়ের বেলায় ইজাব ও কবুল করা হয় এবং ক্রেতা ও বিক্রেতা ও বিক্রীত বস্তুর শর্তাবলি পরিপূর্ণভাবে পালন করা হয়। অর্থাৎ যে ক্রয়-বিক্রয় মূলগত ও গুণগত উভয় দিক থেকে শুদ্ধ নয়, তাকে ‘বাই-বাতিল’ বলা হয়। কেউ কেউ বলেছেন, বিক্রীত বস্তুটি যদি ইসলামী শরিয়াহর দৃষ্টিতে মূল্যমানসম্পন্ন না হয়, তাহলে তার ক্রয়-বিক্রয় বাতিল বলে গণ্য হবে। যেমন—মদ, শূকর, মৃত জন্তু ইত্যাদি ক্রয়-বিক্রয় করা বৈধ নয়। অনুরূপভাবে পাগলের ক্রয়-বিক্রয়ও বৈধ নয়। যদি কেউ এ ধরনের ক্রয়-বিক্রয় করে, তাহলে বিক্রীত বস্তুর ওপর ক্রেতার মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবে না এবং ক্রয়-বিক্রয় কার্যকর হবে না। এজাতীয় ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে বিক্রেতার জন্য মূল্য ও ক্রেতার জন্য পণ্যের ব্যয়-ব্যবহার করা হালাল হবে না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা একে অপরের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস করবে না। কিন্তু পরস্পর রাজি হয়ে ব্যবসা করা বৈধ।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ২৯)
বাই-বাতিলের প্রকারভেদ
বাই-বাতিল ছয় প্রকার। যেমন—
১. অস্তিত্বহীন বস্তুর ক্রয়-বিক্রয় : যে বস্তুর অস্তিত্ব বিদ্যমান নেই, তা বিক্রি করা বৈধ নয়। যেমন—উটের গর্ভজাত বাচ্চার বাচ্চা ক্রয়-বিক্রয় করা।
২. হস্তান্তর অযোগ্য বস্তু ক্রয়-বিক্রয় : যে পণ্য হস্তান্তর করা যায় না তার বিক্রয় বাতিল বলে গণ্য হবে। যেমন—উড়ন্ত পাখি, পানির মাছ, ছিনতাইকৃত মাল ও দখলহীন সম্পত্তি বিক্রি করা জায়েজ নয়।
৩. প্রতারণামূলক ক্রয়-বিক্রয় : বস্তুর গুণাগুণ গোপন করে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে কোনো বস্তু বিক্রয় করা বৈধ নয়।
৪. অপবিত্র বস্তুর ক্রয়-বিক্রয় : অপবিত্র বস্তু শরিয়াহর দৃষ্টিতে যার কোনো মূল্য নেই, তা ক্রয়-বিক্রয় বাতিল বলে গণ্য হবে। যেমন—মদ, শূকর, রক্ত ইত্যাদি হারাম বস্তু হওয়ার কারণে এগুলো ক্রয়-বিক্রয় বৈধ নয়। এ ছাড়া ক্ষতিকর জন্তু ও পাখি, যেমন— বাঘ, সিংহ, কাক, পেঁচা ইত্যাদি বিক্রিও সাধারণভাবে অবৈধ।
৫. বায়নার ভিত্তিতে ক্রয়-বিক্রয় : ‘বাই-উরবুন’ হলো এমন এক ধরনের ক্রয়-বিক্রয়, যেখানে ক্রেতা কোনো পণ্য ক্রয়ের জন্য বিক্রেতাকে বায়না (অগ্রিম মূল্য) প্রদান করে এই শর্তে যে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সে বাকি মূল্য দিয়ে ওই মাল ক্রয় করে নেবে। যদি ক্রেতা ওই মাল ক্রয় না করে, তাহলে তার দেওয়া বায়না (অগ্রিম মূল্য) আর ফেরত পাবে না এবং তা বিক্রেতার কাছে দান হিসেবে গণ্য হবে। এ ধরনের ক্রয়-বিক্রয়কে বেশির ভাগ ইসলামী আইনজ্ঞ বাতিল বলে অভিহিত করেছেন।
৬. পানি বিক্রয় করা : সাধারণত পানি বিক্রয় করা বাই-বাতিলের অন্তর্ভুক্ত। নদ-নদী ও সমুদ্রের পানি সর্বসম্মতিক্রমে বিক্রয় করা নাজায়েজ। কিন্তু বিশেষ প্রক্রিয়ায় প্রস্তুত করা পানি, যেমন—ওয়াসার পানি, মিনারেল ওয়াটার ইত্যাদি বিক্রয় করা যাবে। তবে কোথাও প্রাণ রক্ষা জরুরি হয়ে পড়লে সেখানে এ ধরনের পানি বিনা মূল্যে প্রদান করা ওয়াজিব।